মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসায় গাফিলতি থেকে দুর্নীতির অভিযোগ সিবিআইয়ের কাছেও

Social Share

বিদ্যুৎ মৈত্র, মুর্শিদাবাদঃ এক আরজিকর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুন কান্ড খুলে দিয়েছে রাজ্যের অধিকাংশ মেডিক্যাল কলেজগুলির দুর্নীতির প্যান্ডোরা বাক্স। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই সব দুর্নীতি আকাশ ছুঁয়েছে কোভিড কালে। এমনকি অভিযোগ, চিকিৎসা না পেয়েও মৃত্যু হয়েছে করোনা আক্রান্ত বহু রোগীর। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হাসাপাতালের সরঞ্জাম কেনার নামে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি। সেই দাবি জানিয়ে ও একমাত্র ছেলের মৃত্যুর বিচার চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হন্যে হয়ে ঘুরছেন বহরমপুরের দম্পত্তি।

২০২১ সালের ১৩ মে মাত্র ২৭ বছর বয়সে করোনা আক্রান্ত হয়ে মুর্শিদাবাদের করোনা হাসপাতালে মৃত্যু হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ইঞ্জিনিয়র জয়মাল্য মাজির। তরতাজা ছেলের সেই মৃত্যু আজও মন থেকে মেনে নিতে পারেননি গবেষক দম্পত্তি ডঃ মানসদেব মাজি ও চন্দনা মাজি। একমাত্র ছেলে হারানোর শোক একটু সামলে মানসদেব মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কতৃপক্ষকে চিঠি লিখে জানতে চান ছেলের চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য। কিন্তু কলেজ কতৃপক্ষ তাঁকে আংশিক তথ্য জানান। জানানো হয়নি কোন কোন চিকিৎসক জয়মাল্যর চিকিৎসা করেছিলেন।

তখন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের দ্বারস্থ হন ডঃ মাজি। কমিশন অবশ্য তাঁর আবেদনে সাড়া দেন। তাঁকে লিখিতভাবে জানান হয় ওই হাসপাতালের ২৭ জন চিকিৎসক ও ৪৩ জন নার্স জয়মাল্যর চিকিৎসা করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা তো সকলেই আর জয়মাল্যের চিকিৎসা করেননি। ওই সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স কোভিড হাসপাতালে চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন। সেই চিকিৎসকদের নাম আজও জানতে পারেননি মানসদেব। চিকিৎসকদের গাফিলতিতে ছেলের মৃত্যুর বিচার চাইতে তিনি মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী সর্বত্র অভিযোগ করেছেন। কোথাও সাড়া পেয়েছেন। কেউ কেউ এখনও নীরব।

চলতি বছর জানুয়ারী মাসে ডঃ মাজি আরটিআই করে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের কাছে জানতে চান কতজন রোগী সেই সময় কোভিড ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। ২০২১ এর মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে কত জনই বা মারা যান। সেই তথ্য কলেজ কতৃপক্ষ দেননি। এরপর স্বাস্থ্যভবনে বিষয়টি লিখিতভাবে জানান হয়। তারাও বিষয়টি চেপে যান। পরে সশরীরে স্বাস্থ্যভবনে হাজির হয়ে সেই তথ্য জানতে চান জয়মাল্যর বাবা। পরে অবশ্য তাঁকে সেই তথ্য দেওয়া হয়।

সেই তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের মার্চ মাসে কোভিড হাসপাতালে কোনও রোগীই ভর্তি হয়নি। অথচ মারা গিয়েছেন একজন। এপ্রিল মাসে ১৪৩ জনের মধ্যে ১২০ জন মারা গিয়েছেন। মৃত্যুর হার প্রায় ৮৪ শতাংশ। মে মাসে ২৭৯ এর মধ্যে ১৮৬ মারা যায়। মৃত্যুর হার প্রায় ৬৭ শতাংশ। জুন মাসে ২১ জনের মধ্যে ১৮ জন মারা যান। মৃতুর হার ৮৬ শতাংশ প্রায়। জুলাই মাসে একজন ভর্তি হলেও কেউ মারা যায়নি।

ডঃ মাজির দাবি, সুচিকিৎসা পেলে ওই হাসপাতালে এত রোগীর মৃত্যুই হতো না। তাঁর ছেলের ক্ষেত্রেও চিকিৎসকদের বিরাট গাফিলতি আছে। আর সেই গাফিলতি ঢাকতে তৎপর স্বাস্থ্যভবনও। তিনি বলেন, “স্বাস্থ্যভবন দুর্নীতির আখড়া। আর তার লেজুর জুড়ে আছে মুর্শিদাবাদের মতো সরকারি হাসপাতাল ও কলেজগুলি।” তিনি বলেন, ” যেখানে যেখানে আমি মেইল পাঠিয়েছি সেখানে সেখানে রিপোর্ট পাঠাতে স্বাস্থ্যভবন কাগজ কলমে তদন্ত কমিটি গঠন থেকে আনুষঙ্গিক সবকিছুই গুছিয়ে রেখেছে।”

কিন্তু জয়মাল্যর মৃত্যুর তদন্তে যে কমিটি গঠন হয়েছিল তাদের রিপোর্ট গ্রহণযোগ্যই হয়নি মানসদেবের কাছে। মানসদেব বলেন, “ওরা দায়সারা রিপোর্ট করেছিল।” তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের একুশের ফেব্রুয়ারী স্বাস্থ্যভবনে এই বিষয়ে শুনানি জন্য ডাকা হয় মানসদেবকে। তিনি বলেন, “ডায়রেক্টর হাত জোড় করে বলেন চিকিৎসায় গাফিলতির জন্য আমরা দুঃখিত। কিন্তু লিখিতভাবে আজও কিছু জানায়নি।” ফের স্বাস্থ্যভবনের সচিবকে চিঠি করে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জানতে চান জয়মাল্যর বাবা। সেই চিঠির কপি অন্য সবার সঙ্গে পাঠান সিবিআইকেও।

কেন্দ্রের তদন্তকারী সংস্থার পক্ষ থেকে বিষয়টি নাড়াচাড়া করতে ফের স্বাস্থ্যভবন এই বছর ১৩ অগস্ট ডেকে পাঠায় মানসকে। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় ঠিক কী কী অভিযোগ তাঁর রয়েছে। তিনি সিবিআইকে ফের লিখিত আকারে সব কিছুর তদন্ত করার আর্জি জানিয়েছেন। এই অভিযোগও করেছেন, কোভিডকালে কোনও সিনিয়র চিকিৎসক হাসপাতালে চিকিৎসা করেননি। তাঁরা জুনিয়রদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন দায়িত্ব। স্বাস্থ্যভবন চিকিৎসকদের যে তালিকা পাঠিয়েছেন সেখানে ডাক্তারদের সাক্ষরও বোঝা যাচ্ছে না। কয়েকজন নার্সের সাক্ষর বোঝা যাচ্ছে না। সাধারণ যন্ত্রপাতী যেমন ইসিজি, এক্সরে, কোনও যন্ত্রপাতী ছিল না।”

স্বাস্থ্যভবনকে তৎকালীন হাসপাতাল সুপার অমিয় কুমার বেরা জানিয়েছিলেন, ইসিজি না থাকার জন্য আমরা নিয়মিত জয়মাল্যর হার্টের পরীক্ষা করা যায়নি। সেই দাবি করে মৃত জয়মাল্যের বাবার প্রশ্ন ” তাহলে এত টাকা যে সরকার হাসপাতলকে দিল সেসব কী হল? কোথায় খরচ হল?” তিনি আরও বলেন, ” হাসপাতালে স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা ছিল না। একজন রোগীর বাড়ির লোকের জন্য অতিথিশালা আদালত ও সরকার বললেও তার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। হেল্পডেস্ক ছিল না।” আর সেইসবের তদন্ত করতে সিবিআইকে ফের চিঠি দিয়েছেন ডঃ মাজি।

ওই হাসপাতালের এক সিনিয়র চিকিৎসক বলেন, “সিনিয়রদের একাংশ সত্যিই কোভিড হাসপাতাল এড়িয়ে চলতেন।” ঘটনার সময় অবশ্য হাসপাতালের বর্তমান অধ্যক্ষ অমিত দাঁ ছিলেন না। যদিও তাঁর সাফাই, ” আমরা এখনও জানি না কোভিডের চিকিৎসা কী? চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যকর্মী অনেকে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। মারাও গিয়েছেন। কোনও চিকিৎসকই ইচ্ছা করে কারও ক্ষতি করেন না। তাঁরা রোগী বাঁচানোর সব চেষ্টাই করেন। সিনিয়ররা আজ বলে নয়, বরাবর জুনিয়রদের পাশে থাকেন। সেই সময়ও ছিলেন ডিউটি রোস্টারেই তাঁর প্রমাণ মিলবে।” আর দুর্নীতি প্রসঙ্গে অধ্যক্ষের দাবি, আসলে সকলেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছেন। তিন বছর আগে উনি (মানসদেব) কেন দুর্নীতির অভিযোগ করেননি?”

আরও পড়ুনঃ রাজনীতি থেকে সরলেন জহর সরকার, সাংসদ পদেও ইস্তফা

One thought on “মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসায় গাফিলতি থেকে দুর্নীতির অভিযোগ সিবিআইয়ের কাছেও

  1. অধ্যক্ষ মহাশয়ের নিকট জানতে চাই:

    1. কেন কেন্দ্রীয় সরকারের বা রাজ্য সরকারের কোভিড প্রটোকল অনুসারে আমার পুত্রের চিকিৎসা হয়নি ?

    2. কেন X Ray, CT Scan, Blood, Urine, Suptum Test হয় নি? MSVP National Medical Commission কে জানিয়েছেন যে OMCH এ ECG Machine না থাকার জন্য ECG করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রটোকল অনুযায়ী প্রতিদিন, ECG করা প্রয়োজন।

    3. কেন প্রটোকল অনুসারে অনান্য INVESTIGATION করা হয়নি?

    4. MSVP, NMC কে পাঠানো LIST অনুযায়ী 23 জন ডাক্তার ও 43 নার্স আমার পুত্রের চিকিৎসা ও সেবা শুরুষা করেছেন। যা Totally wrong information. কারণ বাস্তবে কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তার রোগীদের দেখাশোনা করতো। যারা অনভিজ্ঞ ও নিজেদেরই কোন confidence ছিলোনা।

    5. আমি RTI করে আপনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে কতজন ডাক্তার বাস্তবে আমার ছেলের চিকিৎসা করেছিলেন এবং কতজন নার্স দেখশুনা দায়িত্বে ছিলেন? কিন্তু আমাকে জানাননি।

    5. আমি ওই সময়ের Duty Roster RTI করে আবেদন করেছিলাম। জবাবে আমাকে জানিয়েছেন যে আপনার অফিসে Duty Roster নেই। এটিও মিথ্যা।

    6. আপনারা যদি ঠিকঠাক চিকিৎসা করেছিলেন তাহলে সঠিক ডাক্তারদের নাম দিতে ভয় কেন? কেন গোপন করছেন?

    7. কেন DHS Hearing report বারবার আবেদন করার পরে লিখিত জানাছে না।

    8. কেন Principal Secretary, Dept. Of Health and Family welfare, Chief Secretary, National Human Right Commission এর চিঠির উত্তর দিচ্ছেন না। It’s make Crystal Clear that their is something wrong in treatment and MMCH wants to hide HOMICIDE done by the doctors of MMCH & OMCH, Berhampore.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights