সাড়ে তিনশো বছরের এই  দুর্গাপুজোয় রয়েছে প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধ 

Social Share
কাশিমবাজার রাজবাড়িতে অষ্টমীর সন্ধ্যায় মন্ডপের সামনেই চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

 

তুষার ভট্টাচার্য্য, কাশিমবাজারঃ মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের প্রায় পৌনে   চারশো বছরের প্রাচীন লুপ্ত বন্দর নগরী কাশিমবাজারের ছোট রাজা দীনবন্ধু রায়ের বাড়িতে ১০৯২ বঙ্গাব্দে পারিবারিকভাবে  প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয় l ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের এই  দুর্গা পুজোয় আজও  রয়েছে প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধ l

 প্রসঙ্গত, কাশিমবাজারের ছোট রাজা দীনবন্ধু রায় মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা থানার পিরোজপুর গ্রামে জমিদারী সূত্রে বসবাস করতেন l   পদ্মা নদীর  কড়াল গ্রাসে সেই গ্রাম বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায়  তিনি কাশিমবাজারে চলে আসেন l তাঁর পুত্র জগবন্ধু রায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে মেদিনীপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন l তাঁর সময়কালেই  কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির দুর্গা পুজো আভিজাত্য ও বনেদিয়ানার উজ্জ্বলতা এবং আলাদা স্বতন্ত্র  ঘরানা  তৈরি হয়েছিল l

এই প্রাচীন রাজবাড়িতে প্রথম থেকেই  দেবী মূর্তি তৈরি হয় বাংলার এক চালা রীতির সাবেকি ঘরানায় l সেই রীতি এখনও বংশ পরম্পরায় চলে আসছে l রথ যাত্রার দিন দেবীর কাঠামো তৈরি হয় l বর্তমানে সারগাছি মহুলার মৃৎশিল্পী বাঁকা রায় এই রাজবাড়ির দেবী প্রতিমা নির্মাণ করেন l

এই রাজবাড়িতে প্রথম  থেকেই  দুর্গা পুজোর সঙ্গে কুমারী পুজো শুরু হয় l তুলোট কাগজে হাতে লেখা  ৪৫ পাতার পুঁথি থেকে উচ্চারিত হয় পুজোর মন্ত্র পাঠ এবং চন্ডী পাঠ  l এক সময়ে এই রাজবাড়ির পুজোয়  দশমীর দিন ওড়ানো হত কৈলাসের বার্তা বহনকারী নীলকণ্ঠ পাখি l দু’ডানায় রুপোলি রোদ্দুর মেখে উড়ে যেত নীলকণ্ঠ পাখি ওই দূর গগনে শরতের নীলাম্বরী মেঘের দেশে l অবশ্য এখন আর ওড়ানো হয় না নীলকণ্ঠ পাখি l

তুলোট কাগজে হাতে লেখা  ৪৫ পাতার পুঁথি থেকে উচ্চারিত হয় পুজোর মন্ত্র পাঠ এবং চন্ডী পাঠ l

এই প্রাচীন রাজবাড়িতে সেই সময়েই  দ্বীপান্বিতা কালিপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো, কার্তিক, সরস্বতী প্রভৃতি পুজো শুরু হয় l জমিদার দীনবন্ধু রায়ের আমলে এই পারিবারিক দুর্গাপুজোর জন্য সাকুল্যে ২৫টাকা খরচ করা হত l সেই টাকাতেই হাজার তিনেক মানুষকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হত l ছাগ বলি হত l একশো ঢাক, কাঁসর ঘন্টা বাজতো পুজোর চারদিন l হাজার হ্যাজাক বাতি আর ঝাড়লণ্ঠন জ্বালানো হত রাজবাড়ির অন্দর মহলে lব্রাহ্মণ পরিবারের কুমারীদের পুজো করে দেওয়া হত স্বর্ণালংকার l আর দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ করা হত l এই পুজোর প্রথম পুরোহিত ছিলেন যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচাৰ্য l

ষাটের দশকের শেষ দিকে জমিদারী প্রথা বিলোপের পড়ে এই দুর্গা পুজো কিছুটা অনাড়ম্বরভাবে পালিত হয়েছে l তারপরে নব্বইয়ের দশক থেকে এই পুজো আবার জৌলুস ও জাঁকজমকের সঙ্গে শুরু হয়েছে l মুর্শিদাবাদ জেলার এই প্রাচীন দুর্গা পুজো দেখতে প্রতিবছর জেলা এবং জেলার বাইরের বহু মানুষ আসেন l পুজোর চারদিন এখানে এলে মুহূর্তে খুঁজে পাওয়া যাবে প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধ, ঐতিহ্য আর সাবেকিয়ানার অপূর্ব নান্দনিকতার স্পর্শ l

করোনা বিধিনিষেধ থাকায় বাইরের কোনও দর্শনার্থী রাজবাড়ির নাটমন্দিরে অনুষ্ঠিত  এই প্রাচীন পুজো দর্শন করতে পারেন নি দু-বছর l পরের বছর মানে ২০২৩-এ তা পুষিয়ে নিয়েছেন দর্শনার্থীরা। এবছরেও অষ্টমী, নবমী পুজোতেও বহু মানুষ তৃপ্তি ভরে প্রাচীন ঐতিহ্যের পরশ নিতে হাজির হয়েছেন রাজবাড়িতে। এখন পুজোর ক’দিন গান, বাজনা সহযোগে নিখাদ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও এই পুজোর অন্যতম সঙ্গী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights