
বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ টিম টিম করতে থাকা ব্যাথাটা যখন তীব্র হয়ে উঠল তখন ভোর চারটে। আঁধার কেটে সবে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। বছর আঠারোর রিঙ্কি দাস বুঝেছেন এই ব্যথা অগ্রাহ্য করার নয়। মা আর দিদিকে সঙ্গে নিয়ে তড়িঘড়ি চলে আসেন স্থানীয় গোকর্ণ ব্লক হাসপাতালে। সকালেই উচ্চমাধ্যমিকের ইংরেজি পরীক্ষা যে। সাময়িক যন্ত্রণা একবার হজম করতে পারলে জীবনের একটা বছর নষ্ট হবে না। হাসপাতালে পৌঁছে নিজেই চিকিৎসকদের ব্যথা কমানোর ওষুধ দেওয়ার অনুরোধ করেন। চিকিৎসকেরা তাঁর শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে ওষুধ দিলে তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়ি ফিরে স্নান সেরে বইয়ের পাতায় চোখ বোলাবেন কি, তার আগেই ফের তীব্র যন্ত্রণায় একপ্রকার কাহিল হয়ে পরেন রিঙ্কি।
কিন্তু এবার আর কোনও কথা না শুনে মা তরুলতা বড় মেয়েকে সঙ্গে করে রিঙ্কিকে নিয়ে সোজা হাসপাতালে নিয়ে যান। ” অঘটন কী আর বলে আসে বলুন। সে কথা ওকে বোঝাবে কে?” কিন্তু সেখানে গিয়ে চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন এখনও সন্তান প্রসবের সময় হয়নি তবে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হবে। সেই কথা শুনে রিঙ্কি পরীক্ষায় বসার কথা মাকে জানান। কিন্তু মা পরীক্ষায় বসতে দিতে চাননি মেয়ের কষ্ট, যন্ত্রণাক্লিষ্ট শুকনো মুখ দেখে। সূত্রের দাবি, হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে একদিকে প্রসব যন্ত্রণা তারওপর পরীক্ষায় না বসতে পারার মানসিক যন্ত্রণা, দুইয়ের ধাক্কায় অঝোরে কাঁদতে থাকে মেয়ে। চিৎকার চেঁচামেচিতে ছুটে আসেন অন্য রোগীর পরিবার আত্মীয়রা। ছুটে আসেন হাসপাতালে কর্মরত আয়া, নার্স এমনকি চিকিৎসকরাও।
তাঁরা এসে দেখেন কান্নায় দু’চোখ ভেসে যাচ্ছে সন্তান সম্ভবা রিঙ্কির। অবশেষে চিকিৎসকরা পরীক্ষায় বসার অনুমতি দিলে মা ছুটে যান গোকর্ণ এনজি গার্লস হাইস্কুলে। মায়ের কথায় প্রধান শিক্ষিকার অনুরোধের ফোন ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছল কাউন্সিলেও। বন্দ্যোবস্ত হল পরীক্ষার। রিঙ্কি যন্ত্রণা চেপে মন দিলেন প্রশ্নপত্র দেখতে। চিকিৎসকরা বলেছিলেন পরীক্ষা হয়ত দিতে পারবে রিঙ্কি, কিন্তু টানা তিন ঘন্টা লিখে যাওয়া কষ্টের। টানা তিন ঘন্টা লিখতে পারেননি তিনি। মাঝে মধ্যেই বিরতি নিতে হয়েছে ব্যথায়। কুঁকড়ে গিয়েও হাতের কলমকে শক্ত করে ধরে ছিলেন মনের জোরে। বললেন, “এতো যন্ত্রণা নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি শুধুমাত্র বছরটা যেন নষ্ট না হয়ে যায় সেই তাগিদে। পরীক্ষা হয়েছে মোটামুটি।”
তাঁর জন্য অতিরিক্ত কুড়ি মিনিট বরাদ্দ করেছিল সংসদ। রিঙ্কির স্বামী ভিন রাজ্যে রাজমিস্ত্রির কাজ করে। রিঙ্কি বলেন ” এগারো মাস আগে বিয়ে হয়েছে। ভেবেছিলাম সন্তান প্রসব হওয়ার আগে পরীক্ষা হয়ে যাবে। কিন্তু জন্ম কী আর হাতে থাকে?”
বিয়ের বয়সের আগেই রিঙ্কির বিয়ে হয়ে গিয়েছে পলাশির তারানগরের বাসিন্দা বছর কুড়ির এক যুবক রাহুল হালদারের সঙ্গে। সেই যুবকও এ রাজ্যে কাজের জোগার করতে পারেনি। রিঙ্কির মা তরুলতা বলেন, ” উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর বিয়ে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু মেয়ে ভাব ভালোবাসা করেছিল। ছেলের বাড়ি থেকে জোর করছিল। কী আর করব?” তারানগর আর গোকর্ণের মন জুড়েছিল ইন্টারনেট। ফেসবুক থেকে জল গড়িয়েছিল ছাদনাতলায়, বেআইনি জেনেও।
মুর্শিদাবাদ জেলা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার যুগ্ম আহ্বায়ক প্রলয় মণ্ডল বলেন, ” ওই ছাত্রীর মনের জোরকে কুর্নিশ জানাই। তা না হলে এইভাবে লড়াই করে পরীক্ষা দিতে পারত না। তবে পরিবার সচেতন হলে এই অল্প বয়সে কিছুতেই বিয়ে দিত না।” পরীক্ষা মিটে যাওয়ার প্রায় ঘণ্টা চারেক পরে বুধবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ একটি ফুটফুটে সুস্থ কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন রিঙ্কি। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, মা ও মেয়ে ভাল আছে।