সর্ষে ফুল ফোটার অপেক্ষায় থাকেন বহুরূপীরা

Social Share

স্নেহাশিস সৈয়দঃ শ্রীনাথ বহুরূপীর বর্তমান উত্তরসূরিদের এখন নিত্যনতুন সাজে মন নেই। এখন তাঁরা সরষে ফুল ফোটার অপেক্ষায় থাকেন। মাঠে মাঠে সরষে ফুল ফুটলেই মৌমাছিরা সেই ফুলে এসে বসবে। রসে ভরিয়ে তুলবে মৌচাক। সেই চাক ভেঙে মধু বিক্রি করবে সঞ্জয়, স্বপন, সুব্রতরা। মুখে সস্তা রঙ মাখা, সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাক পরা, দেবী, রাজা, মহারাজারা তখন বাস্তবে লোকের দরজায় দরজায় মধু ফেরি করে বেড়াবেন।

শুধু আর্থিক অনটন নয়, সামাজিক বঞ্চনার শিকার হয়েও পেশা ছাড়তে চাইছেন অনেকেই। অন্যান্য জায়গার মতো মুর্শিদাবাদের বহুরূপীদেরও একই অভিযোগ। বহরমপুর শহরের উল্টোদিকে ভাগীরথী নদীর পশ্চিম পাড়ে বসন্ততলার বাজারপাড়া এলাকায় তাঁদের বাস। এখানেই থাকেন সঞ্জয় রায়। সদ্য সারা শহর ঘুরে এসে বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সারা শরীরে সিমেন্টের বস্তা থেকে বের করে নেওয়া নাইলনের সুতোর পোশাক আর কালো সস্তা রঙ মুখে মেখে হনুমান সাজা রূপ দেখে কে বলবে সে সঞ্জয়।

সঞ্জয় জানান, ছোটবেলায় সবজি বিক্রেতা বাবাকে হারিয়েছে সে। তারপর সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় সাঁইথিয়ায় জামাইবাবুর বাড়ি। জামাইবাবু চাঁদু চৌধুরি এলাকায় বিখ্যাত বহুরূপী ছিলেন। ওদের পাড়ার প্রায় ১০০ ঘর বহুরূপী। জামাইবাবুরা দল বেঁধে আসানসোল, রানীগঞ্জ, বর্ধমান ঘুরে বেড়াতেন। সেও দলে ভিড়ে গিয়েও রাম, কৃষ্ণ সেজে ঘুরে বেড়াত। ছড়া বলে অঙ্গভঙ্গি করত। লোকে খুশি হয়ে টাকা দিত। সেই শুরু। তারপর সে আর পেশা ছাড়তে পারেনি।

বাড়ি ফিরে প্রতিবেশীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সঞ্জয় ।সেভাবেই আজও চলছে। অবশ্য, বহুরূপীদের রূপ মাসে মাসে বদল হয়। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তাই প্রতিটি পুজোপার্বণে দেব-দেবীর রূপ এবং ছড়া নিয়ে হাজির হয়। কৃষ্ণ, সীতা, রাম, রাবণ থেকে বাঘ, ভালুক, হনুমান, গণেশ, কার্তিক, হঠাৎবাবু, নন্দঘোষ কোনও কিছুই তাদের সাজার তালিকার বাইরে নেই। পোশাক বলতে পিচ বোর্ডের মুকুট আর যাত্রাপার্টির কাছ থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড কেনা পোশাক। তবে লোককে আনন্দ দিতে চায় আরও কিছু। তাই তারা মজার মজার ছড়া আওড়ায়। প্রতিদিন ওরা সকাল হলেই দুটো পান্তাভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়েন পথে।

বহরমপুরের গোরাবাজার, ভাকুড়ি, চুনাখালি, কাশিমবাজার, খাগড়া, দয়ানগর, বিভিন্ন দোকান-সহ নানা এলাকায় ঘুরে তাঁরা মানুষকে আনন্দ দেন। দূরে বাসে চেপে ধুলিয়ান, জঙ্গিপুর, ফরাক্কা, মালদা পর্যন্ত চলে যান। উপার্জন বলতে কোনও দিন ৮০-১০০ টাকা। আর কপাল ভাল থাকলে বিয়ে, অন্নপ্রাশন প্রভৃতি অনুষ্ঠান বাড়িতে গেলে খাওয়া-সহ টাকা মেলে। ছোটদের সঙ্গে বড়রাও ছড়া এবং অভিনয় দেখে মজা পান। সুব্রতরা জানান, আমরা বহুরূপীর কাজ আর করতে চাই না। লোকশিল্পী হিসেবে একটা পরিচয়পত্রও জোটে না।

বাসে-ট্রেনে ভাড়া দিয়ে যেতে হয়। ছাড়ের সুযোগটুকুও মেলে না। লোকে ভাবে, আমরা ভিক্ষে করছি। কিন্তু দুটো জিনিস যে এক নয়, কে বোঝাবে তাদের। খুব দুঃখ হয় মানুষের ব্যবহারে। তাই নতুন করে এই পেশায় কেউ আর আসতেই চাইছে না। আমরাও চাই না আমাদের সন্তানরা এই পেশায় আসুক। সামাজিক বঞ্চনায় পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন একে একে সবাই। পরবর্তী প্রজন্ম কি তা হলে শ্রীনাথদের চিনবে না, জানবে না, প্রশ্নের উত্তর জানেন না সঞ্জয়রা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights