
বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ কোথাও জল জমতে দেবেন না। জমা জল থাকলে তা সরিয়ে দিন। এমনকি প্রয়োজনের জলও জমিয়ে রাখবেন না। মনে রাখবেন জমা জলেই মশারা বংশে বাড়ে। ডেঙ্গির প্রকোপ কমাতে এই নিদান দিচ্ছে বহরমপুর পুরসভা। দু-পাশ ফেস্টুনে ঢেকে শহরের অলিগলি ঘুরে সেই বার্তা প্রচার করছে টোটো। এদিকে ‘ডানা’র সৌজন্যে দিন দুয়েকের বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিতে শহর বহরমপুরের গর্বের ব্যারাকস্কোয়ারে জমে আছে জল। শুকোচ্ছে না পরপর দু’দিনের রোদেও। ডেঙ্গির ভরা মরশুমে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষজন প্রশ্ন করছেন “এর বেলা?”
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মুর্শিদাবাদ জেলায় বর্তমানে তিন হাজার আটশো জন মানুষ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত। বহরমপুর ব্লকে ১৬৬ জন। বহরমপুর শহরে এখনও ২৮ জনের শরীরে ডেঙ্গির জীবাণু মিলেছে। তারমধ্যে শহরের এক কাউন্সিলরও আছেন। যদিও গত বছরের তুলনায় চলতি বছর জেলায় ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটা কম।

ব্যারাক স্কোয়ারের চারপাশে ঐতিহ্যের সার্কিট হাউস, জেলাশাসকের বাংলো, মহকুমাশাসকের বাংলো, জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের বাংলো ছাড়াও জেলা প্রশাসনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতরও আছে। কিন্তু মাঠের দিকে নজর তাঁদের নেই, বলছেন শহরবাসীই। বহরমপুর পুরসভার চেয়ারম্যান নাড়ুগোপাল মুখোপাধ্যায় বলেন, ” মাঠের দেখভালের দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। পুরসভার নয়।” বহরমপুর সদর মহকুমাশাসক শুভঙ্কর রায় বলেন, “আমরা দেখছি জমা জল কীভাবে বের করে দেওয়া যায়।”
প্রসঙ্গত, কমল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘সিপাহী যুদ্ধে বহরমপুর’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ, আর তার দশ বছর পরে ১৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দে বহরমপুর ব্যারাক নির্মাণের কাজ শেষ হয়। সেই ব্যারাকে ইংরেজ গোরা ও দেশী সেনারা থাকতেন। সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনে বহরমপুরের সেনাদের গুরুত্ব দেওয়া হলেও ম্যালেরিয়ার কারণে বহরমপুর ব্যারাক থেকে গোরা সেনাদের সরিয়ে দেওয়া হয় কাশিমবাজারে । সেই ব্যারাক ছিল এই মাঠেরই চারপাশে।

ঐতিহ্যের সংস্কার করে তাঁকে রঙিন করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিল বহরমপুর পুরসভা। সেই কাজে হাত মিলিয়েছিল মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনও। বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কেউ। করোনার ছায়া যখন একটু একটু করে সরছে, সেই সময় দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে সমান ৪৪০ গজের ব্যারাক স্কোয়ারের পরিধি ছেঁটে তৈরি হচ্ছিল ফুটপাত। বাহারি আলোয় সাজানো মাঠ নিয়ে পুরকর্তাদের দু-চারটে গর্বিত বাক্য বেশ কয়েকবার শুনেওছেন পুরবাসী। কিন্তু ইতিহাস চর্চাকারী প্রকাশ দাস বিশ্বাস বলছেন, ” এসব করে মাঠ আয়তনে কমেছে। সৌন্দর্য্যও নষ্ট হয়েছে।”
কিন্তু তারপর!
ঋতুর ক্যালেন্ডারে অনিয়মিত বর্ষা। প্রকৃতির খামখেয়ালে যে দু-চার বার একটু বেশি বৃষ্টিপাত হয় তখনই মাঠের বুকে জমে জল। জল পেয়ে বিনা বাধায় বেড়ে ওঠে আগাছাও। যেখানে যেখানে সকাল বিকেল হাওয়া বদলাতে আসা মানুষজনের জন্য আরামদায়ক বেঞ্চ বসানো হয়েছে, জল জমছে তার তলায়, চারপাশে। পরিবেশ হয়েছে অস্বাস্থ্যকর। ইদানিং শরীরচর্চার জন্য প্যারালাল বার সহ বেশ কয়েকটি সরঞ্জাম সেই মাঠের চারপাশে পাকাপাকিভাবে বসানো হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। মানুষজন তা ব্যবহারও করেন রোজ, তিন বেলা। সকাল, বিকেল, সন্ধ্যা। কিন্তু জমা জলে ক্ষুব্ধ তাঁরা।
তাঁদেরই একজন দুলাল দত্ত বলেন ” মাঠ এখন অস্বাস্থ্যকর। ব্যারাক স্কোয়ার যাঁদের জন্য সংস্কার করা হয়েছিল তাঁদের স্বাচ্ছন্দের ব্যাপারটা এখন দেখার কেউ নেই। বসার জায়গা করা হয়েছে ভাল কথা, ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজের জন্য যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তাও ঠিক আছে। কিন্তু সার্বিকভাবে মাঠটাই আর মাঠ নেই। নিকাশীর কোনও ব্যবস্থা নেই। বর্ষায় যে ঘাস গজিয়েছিল তা এই সেপ্টেম্বরের কেটে দায় সেরেছে প্রশাসন।”
এই মাঠের চারপাশ মাঝেমধ্যেই ঘুরতে আসেন মৌমিতা মুখোপাধ্যায়। শনিবার সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “শুধু কী তাই। জায়গায় জায়গায় আলোহীন বাতিস্তম্ভের দৌলতে সাপ-খোপের ভয় বর্ষা বাদলে এড়িয়ে গেলেও হোঁচট খাওয়া এড়াতে পারি না।” মহকুমাশাসক বললেন, ” আলোর বিষয়টা পুরসভাই দেখে।” নাড়ুগোপাল বললেন, ” ঝড় জলে দু-একটা খারাপ হয়েছে। ঠিক করে দেওয়া হবে।”