সংবাদ প্রতিনিধি, কলকাতাঃ কলকাতার বুকে একটি সরকারি হাসপাতালে খুন হয়েছেন একজন তরুণী শিক্ষানবীশ চিকিৎসক। আর সেই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে কলকাতা পুলিশের একজন সিভিক ভলান্টিয়ার। তথ্য প্রমাণ লোপাট ও দেরিতে এফআইআর করার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন টালা থানার ওসি অভিজিৎ মন্ডল। আর তারপর থেকেই পুলিশের নিচুতলায় শুরু হয়েছে গুঞ্জন। কারও দাবি, “অভিজিৎ নিজেই মাতব্বরি করতে গিয়ে এই কেসের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন”।
কেউ বলছেন ” আরজিকর হাসপাতালের চিকিৎসক মহলের সঙ্গে কলকাতা পুলিশের উপর মহলের ইথার যোগ যে ছিল তা প্রতিটি ধাপ পর্যবেক্ষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই নিচুতলার পুলিশ সব জেনেও মুখে কুলুপ আঁটতে বাধ্য হয় শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী বলেই। চাকরি বাঁচাতে সবসময় সেই নির্দেশ পালন করতেই হয়। যখন সবদিক বাঁচিয়ে অন্যায় জিতে যায় তখন ঝড়ে বক মরার মতো ফকিরের কেরামতি দাবি করে ওপর তলার পুলিশ। আর বিপদে পড়লে নিচু তলা শাস্তি পায়। এটাই নিয়তি।”
আর সেই প্রসঙ্গেই পুলিশ মহলের নিচু তলায় ফিরছে পুলিশের নিজস্ব সংগঠনের দাবি। বাংলায় জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে পুলিশের দুটি সংগঠন ছিল। একটি পশ্চিমবঙ্গ নন গেজেটেড পুলিশ কর্মচারী সমিতি অন্যটি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন। গেজেটেড পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও খাতায় কলমে সেই পুলিশ আধিকারিকরা নন-গেজেটেড সংগঠনে সরাসরি যুক্ত থাকতেন না। তাঁদের অধিকাংশ জন অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হতেন। পুলিশ সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের ঝান্ডার নিচে না থাকলেও অ্যাসোসিয়েশন ছিল কংগ্রেস ঘেঁষা আর নন-গেজেটেড ছিল বাম ঘেঁষা। যদিও কোনও পুলিশ কর্মীর উপর ‘অন্যায় আঘাত’ নামলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন দুই সংগঠনের সদস্যরাই। শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী হিসেবেই কাজ করতেন সমাজেও।
একটা সময় আইপিএস, আইএএসদের ব্যক্তিগত কাজ করতে ডাকা হতো হোমগার্ড, এনভিএফদের। এমনটাই দাবি সংগঠনের প্রাক্তনীদের। নেতারা আন্দোলন করে হোমগার্ডদের দিয়ে সেই কাজ করানো থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেছিলেন সেই আমলের পুলিশের বড় কর্তাদের। এমনকি দেহরক্ষীদের দিয়ে জুতো বহানোর মতো কাজও করাতেন জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্তারা। যা দৃষ্টিকটূ হওয়ায় তার প্রতিবাদ করতেও পিছপা হতো না সংগঠন।
একইভাবে কোনও থানায় বা কর্মক্ষেত্রে কখনও সেই দফতর বা থানার অফিসার ইনচার্জ তাঁর ক্ষমতা নিচু তলার পুলিশ কর্মীর উপর প্রদর্শন করলে তা মিমাংসার ক্ষেত্রে সংগঠনের বড় ভূমিকা থাকত। এমনও হয়েছে নিচু তলার পুলিশ কর্মীর প্রতি জেলার পুলিশ সুপারের “অন্যায় নির্দেশ”ও লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাতিল হয়েছে সংগঠনের চাপে। যদিও জ্যোতি বসুর তুলনায় বুদ্ধদেব আমলে আইপিএসরা সেই চাপ কম পেয়েছেন বলে দাবি অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের একাংশের। পাশাপাশি ঘুষ নিয়ে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়ার ক্ষেত্রেও সংগঠনের নেতাদের নাম জড়িয়েছিল প্রায় প্রত্যেক জেলাতেই। তবুও নিচু তলার পুলিশ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সংগঠনের ভূমিকা যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা অস্বীকার করছেন না বর্তমান পুলিশের একাংশ।
রাজ্যের পালাবদলের পর ওই দুটি সংগঠন তুলে দিয়ে পুলিশ ওয়েলফেয়ার কমিটি তৈরি হয়। যা নিয়ে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হয়। সেই মামলায় সিঙ্গেল বেঞ্চ সংগঠনের পক্ষে রায় দিয়েছিল। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে রাজ্য ডিভিসন বেঞ্চে মামলা করে। সেই মামলার আজও শুনানি হয়নি বলে ক্ষোভ একাংশ বর্তমান পুলিশকর্মীর। আর সেই সুযোগে রাজ্যে শাখা বিস্তার করে ওয়েলফেয়ার কমিটি। যার মাথায় তামাদি হয়ে যাওয়া সংগঠনের বেশ কয়েকজন চেনা মুখ আছে বলে দাবি প্রাক্তনীদের। আরজিকর হাসপাতালে পিজিটি হত্যার পিছনে ধৃত সঞ্জয় রায়ের সঙ্গে পুলিশ ওয়েলফেয়ার কমিটির যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তা তদন্তে উঠে এসেছে। এই ওয়েলফেয়ার কমিটি শাসকের সহযোগী সংগঠন হিসেবে পরিচিত।
চলতি বছর লোকসভা নির্বাচনের আগে জানুয়ারিতে বারাকপুর লাটবাগানে এই ওয়েলফেয়ার কমিটি একটি সম্মেলন করে। সেখানে রাজ্যের একাধিক মন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচনের মুখে যা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। পুলিশ ওয়েলফেয়ার বোর্ডের নোডাল অফিসার শান্তনু সিনহার মোবাইলে ফোন করে ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সেখানে হোমগার্ড, সিভিক ভলান্টিয়ার, ভিলেজ পুলিশ থেকে রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। সেই সম্মেলনের পর চলতি বছর জুলাই মাসে ৭৩ জনের একটি কমিটি তৈরি করা হয়। যাঁরা জেলা কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করেন। প্রসঙ্গত, এই কমিটির আহ্বায়ক বিজিতাশ্ব রাউত একসময় অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য নেতা ছিলেন।
সেই কমিটির নির্দেশে অভিজিৎ কান্ডের পর ফের নিজেদের ফেসবুক পেজের ডিপি বদল করতে শুরু করেছেন পুলিশ কর্মীদের একাংশ। তেমনি অনেকেই সেই নির্দেশ মানেনও নি। কমিটির ফেসবুক পেজের ডিপি বদলে কালো করা হয়। লেখা হয় “সময়ের প্রয়োজনে।” সোমবার বদল করা সেই ডিপির নিচে এক পুলিশ কর্মী বিশ্বরূপ মুনাইন মন্তব্য করেন, ” শুধু ডিপি চেঞ্জ করলে কিছু লাভ হবে না । এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে খুশি হব। আর কত নিচু তলার কর্মীরা অত্যাচারিত হবে। দয়াকরে জানাবেন একটু ।”
প্রদীপ আঢ্য নামে আর এক পুলিশ কর্মী সেখানে লিখেছেন, ” স্যার, অনেক থানার ও সি ,আই সি সাহেবরা আমাকে জানাচ্ছেন যে এবার আমাদের কিছু বলার করার সময় এসেছে। আপনারা আপনাদের নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলুন। আর চুপ করে বসে থাকা যায় না তাই সবদিক বিচার বিবেচনা করে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য, কিছু একটা ভাবতেই হবে। আমরা আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট কে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি ভালোবাসি। অশোক স্তম্ভ একমাত্র আমাদের মাথার উপরেই বিরাজ করে। সেই অশোক স্তম্ভের যে বা যারা সম্মান রাখতে পারে না তাদের ব্যাপারে ভাবার সময় এসেছে দয়া করে আমাদের অধিকার কিভাবে রক্ষা করা যায়? আসুন সবাই মিলে আলোচনা করি।”
এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ নন-গেজেটেড কর্মচারী সমিতির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি সমীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ” সংবিধান অনুযায়ী সকলেরই সংগঠন করবার অধিকার আছে। সংগঠন করলে যেমন নিজেদের অনেক ভুল, সংশোধন হয় তেমনি অনেক ভাল কাজও করা যায়। পুলিশ হিসেবে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কও ভাল থাকে।” একইসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত এই পুলিশ কর্মীর দাবি, “আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই এই হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার হোক।”
আরও পড়ুনঃ নিজের ছবি সরিয়ে সহকর্মীর রক্তাক্ত মুখের ছবি দিয়ে প্রতিবাদ পুলিশের