সংবাদ প্রতিনিধি, বহরমপুরঃ সমগ্র শিক্ষা মিশনের উদ্যোগে মুর্শিদাবাদ জেলায় বৃহস্পতি ও শুক্রবার কলা উৎসব অনুষ্ঠিত হল বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে। সেখানে খোঁজ মিলল এক ‘দালাল’এর। সরকারি হাসপাতালে দালালরাজ উচ্ছেদও আরজিকর কান্ডের জেরে চলমান আন্দোলনের অন্যতম দাবি। কিন্তু স্কুল পর্যায়ের একটি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিচারকের আসনেও ‘দালাল!’
যা শুনে স্তম্ভিত সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পীঠস্থান বহরমপুরের শিল্প সচেতন মানুষজন। এমনিতেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে বিচারকদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক অভিযোগ ওঠে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। সেখানে বিচারকের যোগ্যতা নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে কোনো প্রতিযোগিতায়, তাহলে তা আখেরে প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্যকেই নষ্ট করে বলে মত তাঁদের।
কারা এই ধরনের বিচারকদের বাছাই করেন? জেলা সমগ্র শিক্ষা মিশনের আধিকারিক ডঃ এষা ঘোষ বলেন, “বিচারকের বিষয়টি জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর থেকে ঠিক করে দেওয়া হয়।” জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক প্রবাল বসাক প্রথমে বলেন “এটা দফতরের বিষয়।” তাঁকে যখন দফতরের বক্তব্য জানানো হয় তখন বলেন, “নদিয়া থেকে এসেছেন ওঁরা।” পরে অবশ্য ” মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ায় ব্যস্ত আছি ” বলে ফোন রেখে দেন। পরে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রক ২০১৫ সাল থেকে স্কুল পর্যায়ে শিল্প, সংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রতিভাবান পড়ুয়া খুঁজতেই এই উৎসবের আয়োজন করছে। নিয়ম অনুযায়ী জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থানাধিকারী রাজ্য পর্যায়ে অংশ নেবে। সেখান থেকে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নেবে রাজ্যস্তরের প্রথম স্থানাধিকারী।
অক্টোবরের ৩ ও ৪ তারিখ বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে মুর্শিদাবাদ জেলার স্কুল পর্যায়ের ছেলে মেয়েদের জন্য বসে আঁকা, ভাস্কর্য নির্মাণ, গল্প বলা সহ সঙ্গীত এমনকি লোকসঙ্গীত প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়েছিল জেলা সমগ্র শিক্ষা মিশনের পক্ষ থেকে। প্রথমদিন সেখানে গল্প বলা ও নাটক প্রতিযোগিতায় ছিলেন একজন বিচারক। একক ও দলগতভাবে প্রতিযোগী ছিল ৮৫ জন। মুখে কিছু না বললেও তা নিয়ে প্রেক্ষাগৃহেই স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের কারও কারও আপত্তিও ছিল। শুক্রবার সেই একই জায়গায় বিচারের গুরুভার সামলাতে এসেছিলেন তিন জন বিচারক। ওইদিন প্রতিযোগীর সংখ্যা ছিল ৪০জন।

তাঁদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন সুখেন্দু মন্ডল নামে এক ব্যক্তি। তিনিও বিচারকের আসনেই ছিলেন বসে। যদিও তিনি বিচারক ছিলেন না। কিন্তু গল্প বলা প্রতিযোগিতা যেখানে প্রতিযোগী একক অথবা যৌথভাবে অংশ নিতে পারবে ও নাটকের সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে পারবে এমন একটা প্রতিযোগিতায় যাঁরা এদিন বিচারকের আসনে ছিলেন তাঁদের কেউ তবলার শিক্ষক, কেউ গীটার শেখান, কেউ নাটকের দলে থাকেন।
অভিযোগ, তিনজনের কাছেই প্রতিযোগীদের প্রাপ্ত নম্বরের তালিকার বদলে তা ছিল একজনের কাছে। তিনজনের ওই একজন ছাড়া বাকি দু’জন ঘন ঘন প্রেক্ষাগৃহের বাইরে যাচ্ছিলেন। এমনকি প্রতিযোগিতা চলাকালীনও তাঁরা কেউ নিজের আসনে থাকছিলেন না ওই একজন ছাড়া। সুখেন্দু , রবীন্দ্রসদন পাক দিয়ে দিয়ে নিজেকে ‘কেউকেটা’ হিসেবে জাহির করেন বলে খোদ দফতরের এক কর্মী অভিযোগ করেন।
প্রতিযোগিতার আসরে তাঁর ভূমিকা জানতে চাওয়া হলে সুখেন্দু বলেন, “আমার হাত ধরেই প্রতিযোগিতার বিচারক ঠিক হয়। আমিই ঠিক করেছি কারা এই প্রতিযোগিতার বিচারক হবেন। তাই আমি ওদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।” তিনি আরও বলেন, ” যাঁরা এসেছেন তাঁরা কলকাতা থেকে এসেছেন।” অথচ বিচারকদের বাড়ি বহরমপুরের পাশে লালবাগে। সুখেন্দুও লালবাগের বাসিন্দা। তিনি এলাকায় গানের শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় আপনার সঙ্গে কে যোগাযোগ করেন? বলেন, “অফিস থেকে সুবীর বাবু যোগাযোগ করেন।” প্রথমে অবশ্য বলেন, “লালবাগ মহকুমার তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক নন্দিতা আমার বাড়িতেই থাকেন। তিনিও বলেছেন।” এমনকি সূত্রের দাবি, বিচারকের প্রাপ্য সাম্মানিক নিয়েও একসময় তাঁকে দর কষাকষি করতে দেখা যায় দফতরের কর্মীদের সঙ্গে।
তবে লালবাগের তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক নন্দিতা পাত্র সুখেন্দুর দাবি উড়িয়ে বলেন, ” আমি ওই ব্যক্তিকে চিনি এই কারণেই উনি এখানকার অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেন। কিন্তু কলা উৎসবে কারা বিচারক হবেন কি হবেন না তা মহকুমাস্তর থেকে ঠিক হয় না। ঠিক হয় জেলা থেকে। তাই এ ব্যাপারে আমার কোনও ভূমিকা নেই।” বহরমপুর মহকুমার তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক সুবীর সরকার বলেন, ” যারা বিচার নিয়ে অভিযোগ করছেন তাঁরাই বিচারকদের যোগ্যতা নিয়ে ভাল উত্তর দিতে পারবেন।”
চলতি বছর সেপ্টেম্বরের শুরুতে ডিস্ট্রিক্ট এডুকেশন ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে একটি রোল-প্লে কম্পিটিশন হয়। সেই প্রতিযোগিতায় মহকুমা পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছিল কাতলামারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। ওই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক তথা নাট্যপরিচালক ও অভিনেতা সন্দীপ বাগচি সেই প্রতিযোগিতায় পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছিলেন।
এমনকি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান পাওয়া সত্বেও পুরস্কার ও শংসাপত্র ফিরিয়ে দিয়ে বিচারকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এদিন তিনি বলেন, ” আমরা চুড়ান্ত পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেদিন কোনও স্থান না পেলেও বিচার নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই। এক্ষেত্রেও যদি কোনও ভাল প্রতিযোগী তার যোগ্যতা অনুসারে বিচার না পায় তাহলে প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য নষ্ট হয়। বহরমপুরে এতগুলি নাট্য সংস্থা আছে। সেখান থেকে বিচারক পাওয়া যায় না।” প্রবীণ নাট্যপরিচালক ও অভিনেতা দীপক বিশ্বাস বলেন, ” এইরকম বিচারক থাকলে বিচারের নামে প্রহসন হয়। বিচারকেরও বিষয়ের চর্চা থাকা দরকার।”